করোনাকালে অনলাইন কোরবানির হাট

করোনাকালে অনলাইন কোরবানির হাট

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে এমন শীর্ষ ১২টি দেশের একটি বাংলাদেশ। এমন এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আসছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ প্রস্তুত করেছেন  এক কোটি ১৯ লাখ পশু। স্বাভাবিক অবস্থায় এইসব পশু ঈদের আগের দিন পর্যন্ত সারা দেশের কোরবানির হাটে বিক্রি হতো। ঢাকার ব্যবসায়ীরা ঈদের ২০ থেকে ২৫ দিন আগে গ্রাম-গঞ্জের খামার ঘুরে ঘুরে কোরবানির পশু ক্রয় করতেন। এ বছর করোনার কারণে ঢাকার ব্যবসায়ীদের দেখা মিলছে না। কোরবানির পশু বিক্রি নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খামারিরা। অতি কষ্টে লালন-পালন করা কোরবানির পশুর ন্যায্যমূল্য পাবেন কি না এই নিয়ে তাদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। জানা গেছে, গাইবান্ধা জেলার ১২ হাজারের বেশি খামারি এবার গরু বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। জেলার ৭টি উপজেলায় ১২ হাজার ৬৭৭টি বাণিজ্যিক পশু খামার আছে। এসব খামারে ৯০ হাজার গরু লালন-পালন করে কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে বড় খামারের ৩৮ হাজার এবং ছোট খামারে ৫২ হাজার গরু  আছে।

এদিকে, পবিত্র ঈদুল আজহা যত এগিয়ে আসছে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের হারও তত বেড়ে চলছে। সংক্রমণ রোধে সারা দেশে সরকার প্রথমে সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা করলেও, পরে তা আরও সাতদিন বাড়িয়ে দিয়েছে। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে কোরবানির হাট নিয়ে যে-রকম তোড়জোড় চলছে, তাতে লকডাউন বা সরকারের বিধিনিষেধ কতটুকু কার্যকর হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। পশু কোরবানির সঙ্গে দেশের সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও আবেগ জড়িত। এ বছর ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হতে পারে। গত বছর ৯৫ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। এই বিপুল সংখ্যক পশুর কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে যে লোক সমাগম হবে, তাতে সংক্রমণ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। করোনা সংক্রমণ যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। আবার ধর্মীয় বিধানও অগ্রাহ্য করা যাবে না। এ অবস্থায় অনলাইন পশুর হাটের আয়োজনই হতে পারে উত্তম বিকল্প। গত বছর অনলাইনে কোরবানির পশু বেচাকেনা হলেও তার পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। প্রায় এক কোটি পশুর মধ্যে মাত্র ২৭ হাজার। এবার অবশ্য অনলাইনে এক লাখ পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। অনলাইনে এক লাখ পশু বিক্রি হলে ন্যূনতম ৫ লাখ মানুষ হাটে আসা থেকে বিরত থাকবেন- এটাও  কম অর্জন নয়।

এ রকম এক কঠিন বাস্তবতায় সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ডিজিটাল হাটের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র উপস্থিত ছিলেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে  ডিজিটাল হাটের আয়োজন করে ই-ক্যাব ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর বাইরে সারা দেশে আরও সাত শ’র অধিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গবাদিপশুর কেনা-বেচা শুরু হয়েছে। ডিজিটাল কোরবানি হাটের পক্ষে সারা দেশের জেলা-উপজেলাগুলোতে প্রচারণা শুরু  করা হয়েছে। অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম দারাজ ২০১৭ সাল থেকে ‘গরুর হাট’ নামক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে কোরবানির পশু বিক্রি করে আসছে। তারা গরুর লাইভ ওয়েট, রং, দাঁত ইত্যাদি দেখে কেনার এবং ছবির পাশাপাশি খামার ও গরুর ভিডিও দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে ‘অনলাইন কোরবানির হাট’ শিরোনামে কোরবানির পশু বিক্রি করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এবার এমন আরও অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম কোরবানির পশু বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ২৩টি অস্থায়ী ও একটি স্থায়ী হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উচিত হবে মহামারীকালে সরাসরি হাটের পাশাপাশি আরও অধিক সংখ্যক ডিজিটাল হাটকে উৎসাহিত করা।

গত বছরের অনলাইন হাটের অভিজ্ঞতার আলোকে এবার অনলাইন হাটে কসাই বুকিংয়েরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কসাইখানায় সর্বোচ্চ এক হাজার পশু কোরবানি হবে। সেখান থেকে ২৬টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানের মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে মাংস পৌঁছে দেওয়া হবে। ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে কোনোরকম বিরোধ হলে তা নিষ্পত্তি করবে ই-ক্যাব। জীবন্ত পশু বা মাংস, যা-ই ডেলিভারি দেওয়া হোক না কেন সরবরাহের এই খরচ বিক্রেতাকে বহন করতে হবে। ক্রেতার কাছ থেকে এ বাবদ আলাদা অর্থ নেওয়া যাবে না। ওয়েবসাইটে ঢুকে ডিজিটাল হাট থেকে পশু কেনা যাবে। পশু বিক্রেতার মোবাইল ফোন নম্বরও যুক্ত করা হয়েছে এসব ওয়েবসাইটে। চাইলে পশু কেনার আগে বিক্রেতার সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলে পশু কেনা যাবে। এই কার্যক্রম যে সম্ভাবনাময় সে-রকম দৃষ্টান্তও কম নয়। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকার কেরানীগঞ্জে বিক্রির জন্য ৬৫৬টি খামারে ৯ হাজার ৬২১টি কোরবানির পশু প্রস্তুত করেছেন খামারিরা। করোনার কারণে ইতিমধ্যে কেরানীগঞ্জের ওইসব খামারের ৬০ শতাংশ গবাদিপশু খামার থেকেই সরাসরি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হয়ে গেছে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ভালোকিনি ডটকম ও বেসরকারি সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘চরাঞ্চলের গরুর অনলাইন হাট’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত ৫ জুলাই রাজধানীর বেইলি রোডের সরকারি বাসভবন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জনসমাগম থেকে দূরে থাকা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। এ পরিস্থিতে অনলাইনে কোরবানি পশু ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ রাষ্ট্রের জন্য ও সরকারের জন্য বড় সহায়ক।

বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাতে ঘটে গেছে এক নীরব বিপ্লব। এ বিপ্লবের ধারা অব্যাহত রাখতে ভারত বা মিয়ানমার থেকে বৈধ বা অবৈধ কোনো উপায়েই গবাদি পশু দেশের ভেতর ঢুকতে দেওয়া যাবে না। কারণ গবাদিপশু উৎপাদনকারীদের অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। তারা যদি ন্যায্যমূল্য না পান, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বেকার হয়ে পড়বেন অসংখ্য মানুষ। গ্রামীণ অর্থনীতির সচল চাকা অচল হয়ে যাবে।

অন্যদিকে, দেশে ডিজিটাল বিপ্লবের কারণে এভাবে এখন দুর্গম চরাঞ্চলের খামারিরাও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত হতে পারছেন। ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারছেন তাদের উৎপাদিত কোরবানির পশু। চরাঞ্চলের মানুষের জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের একটি প্রকল্পও বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ওই প্রকল্প থেকে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে সহায়তা করা হচ্ছে। চরাঞ্চলের মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানারকম সমস্যার মধ্যে জীবন ও জীবিকা নিয়ে লড়াই করতে হয়। তাদের উৎপাদিত প্রাণিসম্পদ যাতে যথাযথ মূল্যে বিক্রি হয়  এবং তারা যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন, এজন্য চরাঞ্চলের অনলাইন পশুর হাট উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে